স্বদেশ ডেস্ক: হামলা যে-ই করুক, সৌদি আরবের দুটি বড় তেলক্ষেত্রে বিস্ফোরণের পর তেলের উৎপাদনে ধস নেমেছে; স্বভাবতই বেড়েছে তেলের দাম। মিত্র বলে সৌদির হয়ে ‘সন্দেহভাজন শত্রু’ ইরানের ওপর চড়াও হওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তেলের দাম বেড়ে গেলে অন্য সব দেশের মতো অন্তত ট্রাম্পের দেশ সহসা বিপর্যস্ত হবে না। কেন? কারণ তারা দুটো রাজ্যে গুহার ভেতর পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল মজুদ করে রেখেছে। বিবিসি সম্প্রতি এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
১৪ সেপ্টেম্বর মনুষ্যবিহীন উড়োযান (ড্রোন) দিয়ে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন আরামকো কোম্পানির আবকাইক ও খুরাইস তেল শোধনাগারে হামলা চালানো হয়। আবকাইকের তেল শোধনাগারটি বিশ্বের বৃহত্তম এবং খুরাইস হচ্ছে সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলক্ষেত্র। এ হামলার দায় স্বীকার করেছে ইয়েমেনের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি। তবে তাদের এত উন্নত ড্রোন প্রযুক্তি নেই বলে এবং হামলা যেদিক থেকে এসেছে- এসব বিবেচনায় নিয়ে মার্কিন প্রশাসন দাবি করছে, এ হামলা আসলে ইরানই চালিয়েছে।
কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিলেও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। সৌদির জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান জানান, হামলার কারণে দিনে অপরিশোধিত তেলের উৎপাদন ৫৭ লাখ ব্যারেল কমেছে, যা সৌদির মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক। এর পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, তেলের বাজার চাঙ্গা রাখতে তাদের মজুদখানা থেকে তেল ব্যবহার করা হবে। তিনি আসলে টেক্সাস ও লুইসিয়ানা রাজ্যে গুহার ভেতর তেলের মজুদখানার কথা বলতে চেয়েছেন। সেখানে ৬৪ কোটি ব্যারেল তেল সংগ্রহ করে রাখা আছে। এটাকে তারা ‘কৌশলগত সংরক্ষণ’ বলে অভিহিত করে। সত্তরের দশক থেকে তারা তেল এভাবে মজুদ করে রাখছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে তেলের ‘জরুরি মজুদ’ আছে যুক্তরাষ্ট্রেরই।
কেন এই মজুদ-কৌশল
১৯৭৩ সালে আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ হয়েছিল। সে যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর সে কারণে ইরান ও সৌদি আরব এবং ইরাক, কুয়েত ও কাতারÑ সবাই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের তেল কেনায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ভবিষ্যতে যেন এমন নিষেধাজ্ঞায় বিপাকে পড়তে না হয়, তাই মার্কিন রাজনীতিকরা গুহায় তেল মজুদ করার পরিকল্পনা সামনে এনেছিলেন।
ওই বছর অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হয়। তিন সপ্তাহেই তা শেষও হয়ে যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও আরও বেশ কয়েকটি দেশের ওপর আরবের তেল নিষেধাজ্ঞা রয়ে যায় পরের বছর মার্চ পর্যন্ত। সে কারণে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২ ডলার পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। ওই সময় পেট্রলপাম্পে গাড়ির লম্বা লাইনের ছবি সংকটের প্রতিনিধিত্বকারী ছবিতে পরিণত হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস শক্তিনীতি ও সংরক্ষণ আইন পাস করে।
কী আছে মজুদখানায়
বর্তমানে চারটি গুহাক্ষেত্রে তেল মজুদ করা আছে; টেক্সাসের ফ্রিপোর্ট ও উইনিতে এবং লুইসিয়ানায় লেক চার্লস ও ব্যাটন রুজে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মনুষ্যনির্মিত লবণের গুহা রয়েছে। সবচেয়ে দীর্ঘ গুহাটা এক কিলোমিটারের মতো।
ভূপৃষ্ঠের ওপর ট্যাংকে রাখার চেয়ে এটা সাশ্রয়ী এবং নিরাপদও। কেননা লবণের রাসায়নিক উপাদান ও ভূতাত্ত্বিক চাপ তেলকে লিক করা থেকে রক্ষা করবে।
সবচেয়ে বড় মজুদখানা আছে ফ্রিপোর্টে। সেখানে ২৫ কোটি ৪০ লাখ ব্যারেল তেল মজুদ রয়েছে। এসব সংরক্ষণশালার ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ১৩ সেপ্টেম্বর চারটিতে ৬৪ কোটি ৪৮ লাখ তেল মজুদ ছিল।
মার্কিন শক্তি তথ্য প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, মার্কিনরা ২০১৮ সালে গড়ে প্রতিদিন ২ কোটি ৫ লাখ ব্যারেল পেট্রোলিয়াম ব্যবহার করেছে। এর মানে জরুরি অবস্থায় দেশটি টানা ৩১ দিন মজুদখানার তেল ব্যবহার করে নিত্যদিনের স্বাভাবিক তেল-চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
কখনো কি ব্যবহৃত হয়েছে
এসব মুজদখানা থেকে তেল ব্যবহার করার অনুমোদন একমাত্র প্রেসিডেন্ট দিতে পারেন, যদি কোনো বিশেষ জরুরি অবস্থা তৈরি হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালে এ তেল ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। আরব বসন্তের কারণে তেলের সংকট দেখা দিলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ তেল ব্যবহারের অনুমতি দেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ১৯৯১ সালে গালফ যুদ্ধের সময় এসব আধার থেকে তেল ব্যবহারের অনুমোদন দেন। তার ছেলে, সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ হারিকেন ক্যাটরিনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল তেল ব্যবহারের অনুমোদন দেন।